কুলি-মজুর (দ্বিতীয় অধ্যায়) (কাজী নজরুল ইসলাম)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সপ্তবর্ণা কবিতা | - | NCTB BOOK
808
808

কুলি-মজুর

কাজী নজরুল ইসলাম

দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে!

চোখ ফেটে এল জল,

এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?

যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সাব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ? চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল!
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল তো এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো, কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!

আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!

(অংশবিশেষ)

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

145
145

দধীচি - ভারতীয় পুরাণে উল্লেখিত একজন ত্যাগী মুনি। এ কবিতায় শ্রমজীবী কুলি-মজুরদের দধীচিমুনির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যে শ্রমজীবী মানুষেরা সভ্যতার বিস্তারে শ্রম দিয়ে সাহায্য করেছেন তারাই আজ অবহেলিত। তাদের শ্রমের ওপর ভর করে যারা ধনী হয়েছেন, তারাই সকল সুবিধাভোগী। কবি দুঃখ করে ত্যাগী দধীচির সঙ্গে ত্যাগী কুলি-মজুরের তুলনা করেছেন।

বাষ্প-শকট - 'শকট' মানে গাড়ি। বাষ্প-শকট হচ্ছে বাষ্প দ্বারা চালিত গাড়ি। এখানে রেলগাড়ি।

পাই - আগের দিনের মুদ্রার ক্ষুদ্র একক বিশেষ। এ কবিতায় 'পাই' বলতে কুলি-মজুরদের মজুরির 'স্বল্পতা' বোঝানো হয়েছে।

ক্রোর - কোটি।

ঠুলি - চোখের ওপরের ঢাকনি। গরুকে যখন ঘানিতে জোড়া হতো, তখন তার চোখে ঢাকনি পরানো হতো। ঐ ঢাকনির নাম 'তুলি'। 'ঠুলি খুলে' মানে সচেতন হয়ে।

অট্টালিকা - প্রাসাদ, অন্য কথায় সুউচ্চ দালান বা ইমারত।

'দিনে দিনে বহু
বাড়িয়াছে দেনা' - অতীতকাল থেকে মানব সভ্যতা শ্রমজীবী মানুষদের অবদানে অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু প্রতিদানে তাঁরা পেয়েছেন অল্পই।

শাবল - লোহার তৈরি মাটি খোঁড়ার হাতিয়ার।

গাঁইতি - পাথর, ইট প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত কঠিন স্থান খোঁড়ার জন্য লাঙ্গলের আকারের দুমুখো কুড়াল।

বক্ষে - বুকে।

নব উত্থান - কোনো ভালো কাজের জন্য নতুন করে উদ্যোগী হওয়া।

common.content_added_by

পাঠের উদ্দেশ্য

135
135

বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি

198
198

কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের 'সাম্যবাদী' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। 'কুলি-মজুর' কবিতায় কবি মানবসভ্যতার যথার্থ রূপকার শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের পক্ষে কলম ধরেছেন।

যুগ যুগ ধরে কুলি-মজুরের মতো লক্ষকোটি শ্রমজীবী মানুষের হাতে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। এদেরই অক্লান্ত শ্রমে ও ঘামে মোটর, জাহাজ, রেলগাড়ি চলছে। গড়ে উঠেছে দালানকোঠা, কলকারখানা। এদের শোষণ করেই ধনিকশ্রেণি হয়েছে বিত্ত-সম্পদের মালিক। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সমাজে এই কুলি-মজুররাই সবচেয়ে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। এক শ্রেণির হৃদয়হীন স্বার্থান্ধ মানুষ এদের শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া বিত্ত-সম্পদের সবটুকুই ভোগ করছে, অথচ এদের তারা মানুষ হিসেবে গণ্য করতেও নারাজ।

common.content_added_by

কবি-পরিচিতি

148
148

অন্যায়, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিপ্লব ও দেশপ্রেমের উদ্দীপনাময় কবিতা লিখে বাংলার জনমনে যিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে নন্দিত আসন পেয়েছেন, তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

বহু বিচিত্র ও বিস্ময়কর তাঁর জীবন। ছেলেবেলায় লেটোর দলে গান করেছেন, রুটির দোকানের কারিগর হয়েছেন, যুদ্ধে যোগ দিয়ে সেনাবাহিনীর হাবিলদার হয়েছেন। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে রাজদ্রোহের অপরাধে কারাবরণ করেছেন। তিনি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

তিনি যে শুধু বড়োদের জন্য লিখেছেন তা নয়, ছোটোদের জন্য লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- 'ঝিঙেফুল', 'সঞ্চয়ন', 'পিলে পটকা', 'ঘুম জাগানো পাখি', 'ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি' এবং নাটক 'পুতুলের বিয়ে'।

নজরুলের কবিতা ও গান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর রচিত 'সন্ধ্যা' গ্রন্থের অন্তর্গত 'চল্ চল্ চল্' গানটি আমাদের রণ-সংগীত। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে।

তিনি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র) ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

common.content_added_by

কর্ম-অনুশীলন

157
157

ক. তোমার দেখা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের একটি তালিকা প্রণয়ন কর (দলীয় কাজ)।
খ. তোমার দেখা একজন শ্রমজীবী মানুষের জীবন-যাপনের উপর একটি বিবরণী লেখ (একক কাজ)।

common.content_added_by

নমুনা প্রশ্ন

424
424

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. কাজী নজরুল ইসলামের মতে কোনটিতে দেশ ছেয়ে গেল?
ক. মোটরে
খ. জাহাজে
গ. কলে
ঘ. রেলগাড়িতে

২. 'কুলি-মজুর' কবিতায় কবি শ্রমজীবীদের জয়গান গেয়েছেন কারণ তারা -
i. অবহেলিত
ii. সভ্যতার নির্মাতা
iii. অধিকারবঞ্চিত
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. iও ii
খ. iও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও:
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা, কূপমণ্ডুক 'অসংযমীর' আখ্যা দিয়াছে যারে, তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।
৩. কবিতাংশের 'ক্ষুদ্রমনা' 'কুলি-মজুর' কবিতায় বর্ণিত কোন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে?
ক. বাবুসাবদের
খ. মিথ্যাবাদীদের
গ. দধীচিদের
ঘ. কুলি-মজুরদের

8. কবিতাংশের মূলভাব 'কুলি-মজুর' কবিতার কোন চরণে প্রতিফলিত হয়েছে?
ক. দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ
খ. তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান
গ. তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান
ঘ. তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি

সৃজনশীল প্রশ্ন

১। এলাকায় একজন ভালো মানুষ হিসেবে চেয়ারম্যান আজমল সাহেবের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে, কিন্তু তাঁর ছেলে কারণে-অকারণে বাড়ির কাজের লোক, আশপাশের খেটে খাওয়া মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। চেয়ারম্যান ছেলেকে ডেকে বুঝিয়ে বলেন, তুমি যাদের আজ তুচ্ছ জ্ঞান করছ সত্যিকার অর্থে - তারাই আধুনিক সভ্যতার নির্মাতা, তাদের কারণেই আমরা সুন্দর জীবন যাপন করছি।
ক. 'কুলি-মজুর' কবিতায় রেলপথে কোনটি চলে?
খ. 'শুধিতে হইবে ঋণ'- কথাটির দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
গ. চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের আচরণে 'কুলি-মজুর' কবিতার কোন দিকটি প্রকাশ পেয়েছে- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. 'চেয়ারম্যান সাহেবের মনোভাব 'কুলি-মজুর' কবিতার মূলভাবেরই প্রতিফলন' বিশ্লেষণ কর।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion